40%
ছাড়বিস্তারিত
উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায়, রাজেনবাবু ও তার স্ত্রী শিশিরকণার মধ্যে অনাগত সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে হবে তা নিয়ে আলাপন। মায়ের ইচ্ছে ছেলে হলেও বাবার ইচ্ছে ফুটফুটে মেয়ে আসুক। তাহলে তিনি রং-বেরঙের ফ্রক, ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুলের চমৎকার ফিতে ইত্যাদি আনতে পারবেন। রাজেনবাবুর মনস্কামনা পূর্ণ করে তাদের ঘরে আসে পরীর মতো এক মেয়ে। রাজেনবাবু নাম রাখেন ‘শ্বেতা’। শিশিরকণা এমন বাহারি নাম দেখে ঠোঁট উল্টান। একে একে তাদের ঘর আলো করে আরও চার মেয়ে এবং এক ছেলেসন্তান আসে। রাজেনবাবু মেয়েদের নাম রাখেন শ্বেতা, মহাশ্বেতা, সরস্বতী, শাশ্বতী, স্বাতীও ছেলে বিজন।রুগ্ণ স্ত্রীর চাপে একে একে মেয়েদের পাত্রস্থ করেন রাজেনবাবু। তিন মেয়ের বিয়ের পর শিশিরকণারর মৃত্যু হলে ছোট্ট স্বাতী আর ওর ছোট্ট দাদা বিজনকে নিয়ে এগিয়ে চলে রাজেনবাবুর সংসার। বাবা হিসেবে তিনি একজন অসাধারণ মানুষ, এমন একজন চমৎকার বাবা খুব কম দেখা যায়।কিন্তুজীবনের একটা পর্যায়ে তিনি বড় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। অবশ্য পুরো উপন্যাসটি একটি নিঃসঙ্গ তার উপন্যাস। বুদ্ধদেব বসুর নিজ জীবনটা কেটেছে নিঃসঙ্গতায়। তার মা মারা যাওয়ার পর বাবা সেই যে সন্ন্যাসব্রতে গেলেন, এরপর আর নিঃসঙ্গতা পিছু ছাড়েনি। সেই নিঃসঙ্গতাই কি বারবার এসেছে তার লেখায়? হতে পারে। সম্ভবত, তার সব উপন্যাসেই থাকে একজন নিঃসঙ্গ ব্যক্তি আর তার হু-হু করা অন্তরের টানাপড়েন।ত্রিশের দশকের অন্যতম প্রতিভাবান কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, অনুবাদক প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। বিশিষ্ট উকিল বাবা ভূদেব বসু ও মা বিনয়কুমারীর একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। ১৯০৮ সালে ৩০ নভেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পরদিনই মাকে হারানো এই সাহিত্যিকের শৈশব কেটেছে কখনো কুমিল্লা, নোয়াখালী কখনোবা ঢাকায়। বাংলা সাহিত্যে পঞ্চপা-বের অন্যতম এই সাহিত্যিক, বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে অনন্য প্রতিভার প্রকাশ ঘটিয়েছেন মেধা ও মননের দ্বারা। তার অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘লাল মেঘ’, ‘বাসরঘর’, ‘কালো হাওয়া’, ‘নির্জন স্বাক্ষর’, ‘পাতাল থেকে আলাপ’...।তার আবির্ভাবের সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। স্বভাবতই ফ্যাসিবাদবিরোধী এই লেখক লেখায় তার পূর্ণ প্রকাশ করেছেন। কিন্তুযা তার মূল মোটিভ ছিল, তাহলো তৎকালীন মধ্যবিত্ত সমাজের চিত্র তুলে ধরা। সুখ, দুঃখ বেদনা এসব ছোটখাটো ঘটনা থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটা ব্যক্তির ভেতরটাকে। তার লেখার মূল বক্তব্যই আমিত্বতে। এই আমিত্ব কী? বিশাল নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো অতি ক্ষুদ্র মেঘটুকুও এক একটি আমিত্বের প্রতীক। তবে তিনি বাস্তব-বিবর্জিত নন। এই আমিত্ব একসময় না একসময় বাঁধনে আটবেই। কিন্তুসেটা কি বন্দিত্ব না আমিত্ব, তা শুধু ব্যক্তি-বিশেষেই বোঝা যায়। উপন্যাসটির মূল চরিত্র অবশ্যই স্বাতী। কাহিনি এগোতে থাকে এই স্বাতীর যাপন নিয়ে, ওর একান্ত নিজস্ব অভিরুচি নিয়ে আর ওর কলেজের প্রফেসর সত্যেনকে ঘিরে।এই সত্যেনের মাঝেও লক্ষ করা যায় রোমান্টিক নৈঃসঙ্গ্য চেতনার সংক্রাম। শৈশবেই তার চিত্তলোকে উপ্ত হয়েছিল নির্জনতা ও নৈঃসঙ্গ্যের বীজ। মাকে হারিয়েছে সে শৈশবে, তাই পারিবারিক বন্ধনের মধুরতা তার জীবনে অনুপস্থিত। এজন্যই বড়দিকে দেখে প্রথম দিনেই নিজের অজান্তেই আপ্লুত হয়ে পড়ে।কাহিনিতে উঠে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু। উঠে আসে একান্নবর্তী পরিবার জীবনের প্রীতিস্নিগ্ধ সম্পর্কের স্পর্শ, আসে জীবনের প্রসন্নপ্রান্তরের হাতছানি। তবে একই সঙ্গে বিপ্রতীপ একটি প্রবণতাও এ উপন্যাসের অন্তর্স্রোতে প্রবহমান।উপন্যাসের কিছু অংশ বা ঘটনাপ্রবাহ কিছুটা একঘেয়ে, আজকালকার ভাষায় কিছুটা মেদবহুল হলেও পাঠকালীন মুগ্ধতা কোথাও আটকায় না।শ্বেতার মধ্যকার প্রবল মা মা ভাব, হারীতের অন্তঃসারশূন্য, বিজনের হঠকারিতা, শাশ্বতীর বোকামি আর সর্বোপরি সত্যেনের অতিসংযমী প্রেম সব মিলিয়ে ভালো লাগার উপন্যাস তিথিডোর।গঠনশৈলীতে এটি মহাকাব্যিক, ক্যানভাসের বিশালতা এ উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাংলা উপন্যাসের ধারায় একটি বিশেষ কালকে ধারণ করে এটি হয়ে উঠেছে যুগন্ধর উপন্যাস। একই সঙ্গে যুগোত্তীর্ণও বটে বুদ্ধদেব বসুর এই ‘তিথিডোর’।
Reviews (0)
Get specific details about this product from customers who own it.
This product has no reviews yet. Be the first one to write a review.